যাবন্ন ক্ষীয়তে কর্ম্ম শুভঞ্চাশুভজেন বা।
তাবন্নাজায়তে মোক্ষো নৃণাং কল্পশতৈরপি।।১।।
মানুষের যতক্ষণ পর্যন্ত শুভাশুভ ফল ভোগী কর্ম
লয় প্রাপ্ত না হয় ততদিন শত কল্প বিগত হলেও মানুষের মোক্ষ লাভ হয় না। কারণ মানুষ যতক্ষণ
না তার সমস্ত কর্ম পরিত্যাগ করে বা কর্মের কর্তা হিসাবে নিজেকে ফলাফল ভোগী মনে
করবে সেই কর্ম ফল মানুষকে মুক্ত হতে দেয় না এবং বারে বারে তাকে এই জীবন চক্রের
পীড়া সহ্য করতে হবে। তাই নানা জায়গায় ভগবান বারে বারে বলেছেন কর্ম করে যাও এবং
কর্মের কর্তা হিসাবে ভগবান কে মনে কর। তাহলে কর্ম ফল সেই মহান কর্তার উপরে বর্তাবে
এবং জীব পাপ পুণ্য বিরহিত হয়ে সেই অমৃত লোকের সন্ধান পাবে।
যথা লৌহময়ৈঃ পাশৈঃ পাশৈঃ স্বর্ণময়ৈরপি।
তাবদ্বদ্ধো ভবেজ্জীবঃ কর্ম্মভিশ্চ শুভাশুভৈঃ।।২।।
শৃঙ্খল সে লোহার হোক বা সোনার হোক তা কেবল
বেঁধে রাখতেই কাজে লাগে সেই রকম কর্মফল শুভ হোক বা অশুভ তা জীবকে বন্ধনে আবদ্ধ করে
রাখে। তাই জীব যতক্ষণ না তার সমস্ত কর্ম সেই মহান শিব চরণে অর্পিত করে ততক্ষণ তার
কর্ম বন্ধন হতে মুক্তি লাভ হয় না।
কুর্ব্বাণঃ সততং কর্ম্ম কৃত্বা কষ্টশতান্যপি।
তাবন্ন লভতে মোক্ষং যাবৎ জ্ঞানং ন জায়তে।।৩।।
শত কষ্ট সহ্য করেও যদি সর্বদা কর্মে রত থাকা
যায় তবুও মোক্ষ লাভ হয় না যতক্ষণ না জীবের আত্ম জ্ঞান হয়। যাগ-যজ্ঞ, জপ-তপ,
ব্রত-উপবাস ইত্যাদি কর্ম মানুষ অনেক কষ্ট সহ্য করে করে থাকে। কিন্তু মানুষের মধ্যে
যতক্ষণ না পূর্ণ জ্ঞানের প্রকাশ হয় ততক্ষণ এই সমস্ত কর্মের দ্বারা সে মোক্ষ লাভ
করাতে পারে না। তাই মানুষের উচিত সর্ব প্রকারে সেই চেষ্টা করা যাতে মানুষের আত্ম
জ্ঞান লাভ হয়ে থাকে।
জ্ঞানং তত্ত্ববিচারেণ নিষ্কামেনাপি কর্ম্মণা।
জায়তে ক্ষীনতমসাং বিদুষাং নির্ম্মলাত্মনাম্।।৪।।
জ্ঞানের দ্বারা তত্ত্ব সমূহকে বিচার করে ও
নিষ্কাম ভাবে সকল কর্ম সম্পাদন করলে মনের অন্ধকার নাশ হতে থাকে এবং জীব বিদ্বান ও নির্ম্মলাত্মা
হয়ে ওঠে। মানুষ জ্ঞানের আলোকে আলোকিত হতে থাকে।
ব্রহ্মাদিতৃণপর্য্যন্তং মায়য়া কল্পিতং জগৎ।
সত্যমেকং পরং ব্রহ্ম বিদিত্বৈবং সুখী ভবেৎ।।৫।।
ব্রহ্মাদি দেবতা থেকে সামান্য ঘাস অবধি সকল
পদার্থে পূর্ণ এই জগত হল মায়া দ্বারা কল্পিত। তাই যিনি সেই একমাত্র সত্য পরম পুরুষ
কে জানতে পারেন তিনিই প্রকৃত সুখী হতে পারেন।
বিহায় নামরূপাণি নিত্যে ব্রহ্মণি নিশ্চলে।
পরিনিশ্চিততত্ত্বো যঃ স মুক্তঃ কর্ম্মবন্ধনাৎ।।৬।।
নাম এবং রূপ পরিত্যাগ করে যিনি সেই নিত্য
নিশ্চল ব্রহ্মকে তত্ব সহকারে জেনেছেন তিনি নিশ্চয় এই শুভাশুভ কর্ম বন্ধন থেকে
মুক্ত হয়েছেন। এই দৃশ্যমান ও অদৃশ্যমান জগত কে আমরা নির্দিষ্ট নাম এবং আকার
অনুযায়ী জেনে থাকি, কিন্তু যিনি এই সমস্ত জগতে একমাত্র সেই পরম পুরুষ কে দেখতে পান
তিনি যথার্থ জ্ঞানী হওয়ার জন্য তিনি মুক্ত।
ন মুক্তির্জপনাদ্ধোমাদুপবাসশতৈরপি।
ব্রহ্মৈবাহমিতি জ্ঞাত্বা মুক্তো ভবতি দেহভৃৎ।।৭।।
জপ, হোম ও শত শত উপবাস করলেও জীব মুক্তি লাভ
করে না। কিন্তু সেই ব্রহ্মকে নিজের স্বরূপ হিসাবে দেখতে পেলেই এই দেহ ধারণ করেই
মোক্ষ লাভ হয়ে থাকে। সেই পরম পুরুষ যদি সর্ব ব্যাপক হয়ে থাকেন তাহলে আমার মধ্যেও
নিশ্চয় তিনি আছেন, তাই আমার মধ্যে তাকে যখন আমি আবিষ্কার করে থাকি তখন আমার স্বরূপ
উপলব্ধি হয়ে থাকে। আর এই উপলব্ধি বিশেষ জ্ঞানের উৎপত্তিস্থল এবং এই বিশেষ জ্ঞান হয়ে
থাকলেই জীব সমদর্শী হয়ে মুক্তি লাভ করে থাকে।
আত্মা সাক্ষী বিভু: পূর্ণ: সত্যেহদ্বৈতঃ
পরাৎপরঃ।
দেহস্থোহপি ন দেহস্থো জ্ঞাত্বৈবং মুক্তিভাগ্ভবেৎ।।৮।।
আত্মা কে জাগ্রত, নিদ্রিত ও সুষুপ্ত এই তিন
অবস্থার সাক্ষীস্বরূপ, সর্বব্যাপী ষড়ৈশ্বর্য্যপূর্ণ, সত্য, অদ্বৈত, পরাৎপর অথচ এই
দেহস্থ হয়েও দেহস্থ নয় এইভাবে যিনি জেনেছেন তিনি মোক্ষলাভ করে থাকেন।
বালক্রীড়ানকং সর্ব্বং রূপনামাদিকল্পনাম্।
বিহায় ব্রহ্মনিষ্ঠো যঃ স মুক্তো নাত্র
সংশয়ঃ।।৯।।
বাচ্চাদের খেলনার মত যিনি এই মায়াকল্পিত নাম
রূপ ইত্যাদি পার্থিব সামগ্রিকে পরিত্যাগ করে কেবল মাত্র ব্রহ্মনিষ্ঠ হয়ে থাকেন
তিনি যে সদা মুক্ত তাতে কোণ সন্দেহ নেই। বাচ্চারা যেমন খেলনা নিয়ে খেলার সময় এই
পুতুল কে বাবা, ওই পুতুল কে কাকা, মাসী পিসি ইত্যাদি মনে করে খেলে এবং খেলা শেষ
হলে সেই পুতুল গুলিকে মাটিতে ফেলে দিয়ে চলে যায় এবং সেই পুতুলগুলির কথা তার মনেই
আসে না তেমনি যে জ্ঞানী ব্যাক্তি নাম এবং রূপ সর্বস্ব এই সংসারের মায়া কাটিয়ে সেই
পরম পুরুষ শিবের ধ্যানে নিমগ্ন থাকতে পারেন তিনিই মুক্ত।
মনসা কল্পিতা মূর্ত্তি নৃণাঞ্চেন্মোক্ষসাধনী।
স্বপ্নলব্ধেন রাজ্যেন রাজানো মানবো স্তদা।।১০।।
মনের দ্বারা কল্পিত দেব-দেবীর প্রতিমূর্তি যদি
জীবকে মোক্ষদান করতে পারতো তাহলে স্বপ্নে মানুষ যে নিজেকে রাজা উজির হতে দেখে তার
ফলে সে রাজা হতে পারে না কেন? মানুষ
কল্পিত আকার বিশিষ্ট দেব-দেবীর উপাসনাতে মানুষের চিত্তশুদ্ধি হতে পারে সত্য কিন্তু
তার দ্বারা মুক্তিলাভের আশা করা যায় না। (continue...)
No comments:
Post a Comment